পা ফেলি পাহাড়ে

পা ফেলি পাহাড়ে

বান্দরবানের রুমায় ঋজুক ঝরনা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আশরাফ আমাদের দলনেতা, দলে আমরা ছয়জন। কইক্ষ্যং ঝিরি বাজার থেকে নৌকা নিয়ে সোজা ঋজুক। সেদিন বৃষ্টি ছিল বলে ঋজুক নাচছিল। আমরাও ইচ্ছামতো শরীর ভিজিয়েছিলাম। দুপুরে ফিরে খেয়েছিলাম রুমা বাজারে। এরপর সেনাক্যাম্পে গিয়ে নাম নিবন্ধন করালাম। ১০ মিনিটের বিরতিতে চা খেয়ে রওনা হলাম মংপ্রোপাড়ার দিকে। বাজারের কাছে এডেনপাড়া পার হয়ে পেলাম ঝিরি, চললাম পা চালিয়ে। সন্ধ্যার আগে পেঁৗছে যেতে হবে। সূর্য হেলে পড়ায় তেজ বেশি ছিল না। সবুজ গাছপালাও চলেছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। সূর্য হেলছে আর রূপও বদলাচ্ছে প্রকৃতি। বেশ একটা মিষ্টি ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার একটু আগেই পেঁৗছলাম মংপ্রোপাড়ায়। বেশ গোছানো একটা পাড়া। মাঝখানে বড় একটা জামগাছ আছে। ঘরগুলো বাঁশ-বেড়ার মাচার ওপর।
পরদিন সকাল সকাল হাঁটা দিলাম, উদ্দেশ্য বড়থলিপাড়া। রাঙামাটি জেলায় পড়েছে পাড়াটি, তবে বান্দরবানের সীমানাসংলগ্ন। জয় ও লালকে আমরা গাইড হিসেবে নিয়েছি মংপ্রোপাড়া থেকে। পলিপ্রাংসাপাড়ায় যেতে দুই ঘণ্টা লাগল। মারমা জনগোষ্ঠীর বাস হেথা। পাড়া দেখা শেষ করে দুটি বাতাবিলেবু সাবাড় করলাম। পাড়া থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে আরেকটা ঝরনা পেলাম। সববার যেমন হয়, এবারও গা ভেজানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। ওদিকে ব্যাচেলর রাজিব, বউপালিত (গৃহপালিত থেকে এসেছে) আমিনুল আর আলোকচিত্রী লুৎফর উঠে গেল ঝরনার উৎস দেখতে। বেলা মাথায় না চড়তেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আধঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে আবার পথে নামলাম।
অল্পক্ষণেই পথ হারাল গিয়ে ঝিরির মাঝে। প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটার পরও আমরা ঠিক পথ পেলাম না। পথপ্রদর্শকই পথ হারিয়ে বসেছে, আমাদের আর কী দোষ! একটা বড় জুম ক্ষেতের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। হেমন্ত ভালোই ভর করেছে পাহাড়ে। ধানের ফলন হয়েছে দারুণ। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে সবুজে। হারিয়ে যাওয়ার ভয় শিকেয় তুলে জুম ঘরে বসে বিস্কুট খেতে খেতে পা দোলাতে থাকলাম। খাওয়া শেষ হলে আবার ভয় ফিরে এল। তবে জুমচাষিদের একজন পথ বাতলে দিয়ে এবারের মতো উদ্ধার করল। জোঁকের কামড় খেয়েদেয়ে থলিপাড়ায় গিয়ে পেঁৗছলাম রাত ৯টায়। সেনাক্যাম্পে নামধাম লিখিয়ে গেলাম নাইতে। নদীর নাম রাইক্ষ্যং। তুমুল হিল্লোল গতরে। আমরাও পাল্লা দিয়ে গোসল সারলাম। রাতের খাবার খেলাম মুরগির লাল ঝোল দিয়ে। তারপর কার্বারির ঘরে গিয়ে ঘুমে দিলাম ডুব।
আমাদের আজ তৃতীয় দিন। সকালে থলিপাড়ায় কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলাম। কার্বারির মেয়েদের সঙ্গে গল্পও জমল বেশ। তাঁরা চার বোন। বড়টি খাগড়াছড়িতে মাসির বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে, দশম শ্রেণীতে। ওদের সঙ্গে ছবি তুলে আবার রওনা দিলাম। পাড়ার একটা ছেলেকে সঙ্গে নিলাম পথ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। পথ বেশ গড়বড় আর ত্যাড়াবেড়া। সাড়ে চার ঘণ্টা পর একটা ঝিরি পেলাম। বড় বড় পাথরের ফাঁক গলে পানিপথ খুঁজে নিচ্ছে। এখান থেকে আরো দেড় ঘণ্টা পর পেলাম পুকুরপাড়া। পাহাড়ের থালায় বেশ সড়সড় এই পুকুর। পানি চমৎকার নীল। পুকুরের ধার ঘেঁষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘরবাড়ি। নিচের পাড়াটির নাম প্রাংজং। দুই পাড়ার বাসিন্দারাই ত্রিপুরা। রাতে হেদায়েত বার-বি-কিউ করল। খেতে দারুণ লাগল! বউপালিত আমিনুল এখানে এসে নতুন নাম পেল বড়থলি আমিনুল। বলতে গেলে সবার অলক্ষ্যেই দুটি মুরগি সাবাড় করে দিয়েছে সে। এত বড় থলি যার, তার তো নতুন নাম প্রাপ্যই। খাওয়ার পর জম্পেশ গান-বাজনা হলো।
পরদিন প্রাংজংপাড়ার ছোট্ট একটি ছেলে আমাদের নিয়ে চলল রাইক্ষ্যং জলপ্রপাত দেখাতে। জঙ্গল ঠেলে দুই ঘণ্টায়ই পেঁৗছে গেলাম। বড়সড় জায়গাজুড়ে পানির প্রবল তোড়। পথ পিচ্ছিল, পাথুরে। জায়গাটা অনিন্দ্যসুন্দর। বরাবরের মতো পানিতে নেমে গেলাম। এরপর ছেলেটি আরেকটা ঝরনা দেখাতে নিয়ে গেল। আধা ঘণ্টার বুনো পথ। ঝরনাটি সরু, তবে অনেক পানি ধরে। এর নাম আমরা দিলাম রাইক্ষ্যং ঝরনা।
দুপুরে মাছ ভাজা খেয়ে রওনা দিলাম, আনন্দপাড়া যাব। বৃষ্টি পথ আটকাল, থেমে গেলাম হেডম্যানপাড়ায়। রুমা খালের পাশে এই মুরংপাড়া। রুমা খালের ঝিরঝির শব্দ সারা রাত সঙ্গ দিল। সকালে খেলাম নুডলস। দেখতে গেলাম রুমা খালের জলপ্রপাত। ঢাকা থেকে আসা আরো একটা দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এখানে। তারাও যাচ্ছে আনন্দপাড়ায়। খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে জোঁকের আক্রমণ সইতে হচ্ছে। চার ঘণ্টা পর আনন্দপাড়ায় পেঁৗছলাম। রাতে খিচুড়ি খেলাম মুরগি দিয়ে।
সকালে রওনা হলাম বগা লেকের দিকে। এক ঘণ্টা লাগল সাইকতপাড়ায় যেতে। দেশের সবচেয়ে উঁচু বসতি এ পাড়ায়। সুন্দর গোছানো। ফুলের গাছ আছে অনেক। স্কুলও আছে একটি। আরো কিছুদূর গিয়ে পেলাম হারমানপাড়া। হারমানপাড়া থেকে আরেকটু এগিয়ে একটা ঝরনাও পেলাম। বগা লেকে পেঁৗছলাম দুপুরবেলা। পানি পেলেই গোসল করার রেওয়াজ আমাদের। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না। বিকেলটা শুয়ে-বসেই কাটালাম। বগা লেক আসলে আয়েশ করার জন্যই। বিছানায় গা ঢেলে দিয়ে চেয়ে থাকা পানিপুরীতে। রাতে পাড়ার এক ছেলে গিটার নিয়ে এল। গান ধরল, হোয়্যারএভার ইউ গো, হোয়াটএভার ইউ ডু, আই শ্যাল বি রাইট হিয়ার, ওয়েটিং ফর ইউ।
পরদিন দুপুর নাগাদ পেঁৗছলাম রুমা বাজারে। নৌকা একটা ঠিক করলাম, সোজা বান্দরবানে যাব। রুমা থেকে পুরো পথ নৌকায় এর আগে কখনো যাইনি। এটা বেশ আনন্দেরই হবে মনে হচ্ছে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার ফকিরাপুল থেকে হানিফ, এস আলমসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে বান্দরবানে যাওয়া যায়। ভাড়া ৪৫০ টাকা। বান্দরবান থেকে কইক্ষ্যং ঝিরি পর্যন্ত চান্দের গাড়িতে জনপ্রতি ভাড়া ৬৫ টাকা। কইক্ষ্যং ঝিরি থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত নৌকায় ভাড়া লাগে জনপ্রতি ৩০ টাকা।

 

সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৯/১১/২০১১ ইং